শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বার ২০২৫,

প্রফেসর আমিনুল ইসলাম

জুলাই বিপ্লব: বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের প্রত্যাশা

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন যা জুলাই বিপ্লব নামে অভিহিত, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। জুলাই বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা কিন্তু সবধরনের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, আদর্শগত বিভক্তির উর্ধ্বে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরে যে অভিভাবকরা তাদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তারাও নিতান্তই শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদের সাধারণ মানুষ হিসেবে বিবেকের তাগিদে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। জুলাই বিপ্লব তো ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ছাত্রদের বিপ্লবগুলোর শক্তির বহিঃপ্রকাশ। মানুষের মাঝে বছরের পর বছর ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকা অসন্তোষ মেঘ জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ঝড়ে পড়ল। তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলন শাসকদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে না পারলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না।

গত ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সম্মুখে শুরু হওয়া কোটা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ৫ আগস্ট, বিগত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসা স্বৈরচার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে একাধিকবার একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণের সঙ্গে উপহাস করেছে তৎকালীন সময়ের সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে গৃহযুদ্ধ ব্যতীত নিজ দেশের পুলিশ, প্রশাসন ও অন্যান্য বাহিনী দ্বারা জনগণকে হত্যার মতো ঘটনা খুব কমসংখ্যক সরকার ঘটিয়েছেন। তাও আবার নৃশংসতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সবথেকে বড় এবং নজিরবিহীন ‘সরকার সমর্থিত’ গণহত্যা। যেহেতু যুদ্ধের পর এত বেশি সংখ্যক মানুষ পূর্বের কোনো আন্দোলনে নিহত হয়নি, তাই সংগত কারণেই জুলাই বিপ্লব বা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বিপ্লব পরবর্তী দেশে জনগণের প্রত্যাশাও আকাশচুম্বী। কারণ বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে বারবার রক্তদানের ইতিহাস হলেও প্রতিবারই তারা স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী হয়েছে।

যে প্রত্যাশার হাত ধরে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল কোনো সরকারই এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সেই আকাঙ্ক্ষাকেই পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার দেশের জনগণকে তাদের প্রত্যাশিত আইনসভা, বিচার বিভাগ, শিক্ষানীতি, সর্বোপরি ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ তৈরি করতে পারেনি।

তাই বর্তমান পরিস্থিতি এবং ইতিহাসের আলোকে দেশে এক ধরনের প্রত্যাশার ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। যে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এতগুলো জীবন বিসর্জন দেওয়া হলো, সেই ফ্যাসিবাদ থেকে কি আমরা আসলেই রেহাই পেয়েছি? নাকি আমরা আবারও সেই সনাতন রাজনীতির বেড়াজালে ধরা পড়তে চলছি? জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দলের শূন্যতা তৈরি হওয়ায় জনগণ একটি পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে ন্যায়ভিত্তিক সমাজেরও প্রত্যাশা করতে শঙ্কা প্রকাশ করছে। এই শঙ্কা দূর করাটাই এখন বাংলাদেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং শঙ্কা দূর করার ওপরই নির্ভর করছে রাষ্ট্র হিসেবে আগামীর বাংলাদেশ ও তার অর্থনীতি কোন পথে যাবে। পাশাপাশি এটিও মনে করা যায়, সেই শঙ্কা দূর করতে না পারলে বা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা যদি এবারও ব্যর্থ হয়, যদি আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পাশাপাশি জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণের দিকগুলো নিশ্চিত না করা যায়, যদি আমাদের অর্থনৈতিক - সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অথবা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিক ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার মনোভাব দূর না করা যায়, যদি নিজের অর্থনৈতিক লাভের আশায় প্রাণ-প্রকৃতির দিক বিবেচনা না করা হয়, যদি লোক দেখানো উন্নয়ন লোকালয় ধ্বংস করে, যদি ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ বৃহত্তর সামষ্টিক স্বার্থের চেয়ে গুরুগুপূর্ণ হয়ে ওঠে তা হলে জুলাই বিপ্লব আর এই বিপ্লবে নিহতদের আত্মত্যাগ দুটোই বিফলে যাবে।

তাই জনগনের রক্তের উপর দিয়ে যে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে জনগনের স্বার্থেই যেন সেই বিপ্লবের মূল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হয়। রাজনৈতিক মেরুকরণ, দলীয় বিভাজন অথবা স্বার্থের যে রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত হয়েছে সেগুলোর বাইরে গিয়ে জনগণের ন্যার্য অধিকারগুলো যেন সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় তাহলে বাংলাদেশ আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয়না। এটিই সময়, এটিই সর্বোচ্চ সুযোগ ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার। জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিতে এবং রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় দেশের জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের রাজনীতিই আগামীর বাংলাদেশকে পথ দেখাবে। জনগণ এবং রাজনীতিবিদদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তই বলে দেবে আগামীর বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে। আমরা কী চাই-সিদ্ধান্ত এখন আমাদের ওপরেই। ইতিহাসের শিক্ষা? নাকি পুরানো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

জুলাই বিপ্লব যেন কোনো একক দল বা গোষ্ঠীর দলীয় অর্জন না হয়ে ওঠে। জুলাই বিপ্লব যেন আমাদের নতুন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কারের, নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে, নতুন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন পুরোনো সব জরাজীর্ণ ব্যবস্থার পাটাতনে আঘাত হানবে, জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন সব প্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিলোপ সাধন করে আমাদের নতুন আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাবে- সেই প্রত্যাশাই করি।