বুধবার, ০৬ আগষ্ট ২০২৫,

ছদাহার প্রথম মসজিদ মেহের আলী কাজী জামে মসজিদ

ছদাহার কালজয়ী আলেম-ওলামাদের কীর্তিগাথা

সাতকানিয়ার ছদাহার ইতিহাস বহু গুণী ও জ্ঞানী মানুষের পদচারণায় সমৃদ্ধ। যুগে যুগে এই জনপদে জন্ম নিয়েছেন এমন সব ক্ষণজন্মা আলেম-ওলামা, যাঁদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও কর্মের প্রভাব শুধু ছদাহা নয়, বরং পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। নিচে তাঁদের কয়েকজনের জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো:


হযরত মাওলানা শাকুরুল্লাহ শাহ ছমরকন্দী (রহঃ)

ছদাহার ধর্মীয় ইতিহাসের অন্যতম পথিকৃৎ হলেন হযরত মাওলানা শাকুরুল্লাহ শাহ ছমরকন্দী (রহঃ)। ১১৬৪ হিজরী সনে তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমরকন্দ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসে ছদাহায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর বংশ থেকে অসংখ্য জ্ঞানী ও প্রসিদ্ধ আলেম জন্ম নেন, যাঁদের মধ্যে তাঁর পুত্র হযরত ছগীর শাহ (রহঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই মহান আলিম ও কামিল ওয়ালীর নামেই বর্তমান মৌলভী পাড়ার নামকরণ হয়েছে 'ছগীর শাহ পাড়া'। হযরত ছগীর শাহ (রহঃ)-এর পাঁচ পুত্র ছিলেন—হযরত আবদুল জব্বার শাহ প্রকাশ বুড়া মাওলানা সাহেব (রহঃ), মাওলানা আবদুল খালেক শাহ (রহঃ), মাওলানা আরহামুল্লাহ শাহ (রহঃ), মাওলানা হাজী গরীবুল্লাহ শাহ (রহঃ), এবং মাওলানা দরবেশ কুদরত উল্লাহ শাহ (রহঃ)। তাঁদের মধ্যে মাওলানা হাজী গরীবুল্লাহ শাহ (রহঃ)-এর মাজার চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে 'গরীবুল্লাহ শাহের মাজার' নামে পরিচিত।


হযরত মাওলানা শাহ আবুল খায়ের সাহেব (রহঃ)

ছদাহার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে যিনি চিরস্মরণীয়, তিনি হলেন হযরত মাওলানা শাহ আবুল খায়ের সাহেব (রহঃ), যিনি 'বড় মাওলানা সাহেব' নামে পরিচিত ছিলেন। অবিভক্ত বাংলায় তাঁর সুখ্যাতি এতটাই ছিল যে, তাঁর বদৌলতে সে সময় ছদাহার নাম পশ্চিম বাংলা পর্যন্ত পরিচিতি লাভ করে। তিনি ছিলেন আলিমকুলের মধ্যমণি। তাঁর এবং হযরত মাওলানা আবদুল জব্বার প্রকাশ 'বুড়া মাওলানা সাহেব'-এর মাজার হাঙ্গর খালের তীরে আজও বিদ্যমান।


মুফতি আজম হযরত মুফতি ইয়ার মুহাম্মদ সাহেব (রহঃ)

মুফতি আজম হযরত মুফতি ইয়ার মুহাম্মদ সাহেব (রহঃ) ছদাহার অন্যতম প্রধান আলেম ওলামাদের একজন। তাঁর পূর্বপুরুষ হীরা গাজী শাহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসে কাজী বাড়িতে মেহের আলী কাজী (রহঃ) সাহেবের আতিথেয়তা লাভ করেন। হীরা গাজী শাহের বংশধর মুফতি ইয়ার মুহাম্মদ সাহেব অল্প বয়সেই হিন্দুস্তান হয়ে আরব দেশে যান এবং আরবী ও ফারসি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। তৎকালীন শাসক মুহাম্মদ শাহ তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে 'মুফতিয়ে আজম' উপাধিতে ভূষিত করেন। বর্তমান মুফতি পাড়ার নামকরণ তাঁর নামেই হয়েছে এবং সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।


হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ সাহেব (রহঃ)

কাজী বংশের আরেক প্রখ্যাত আলেম ছিলেন হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ সাহেব (রহঃ)। তিনি অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ-এর আরবি ও ফার্সি বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রামের মোহসেনিয়া মাদ্রাসার (বর্তমান হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ) অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাজী পুকুরের পাড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত এই মহান আলেমের লেখা বহু মূল্যবান ইসলামী গ্রন্থ রয়েছে, যা ইসলামি শিক্ষা প্রসারে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তাঁর রচিত বইগুলো নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে।


হযরত মাওলানা মুহাম্মদ মুতিউল্লাহ সাহেব (রহঃ)

ছদাহার আজিমপুরের প্রখ্যাত আলেম ছিলেন হযরত মাওলানা মুহাম্মদ মুতিউল্লাহ সাহেব (রহঃ)। তিনি ১৮৮০ সালে নিজ বাড়ির পাশে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তিনি এবং তাঁর ছেলে মাওলানা আবদুল বারী সাহেব (রহঃ) প্রকাশ ফকির মাওলানা সাহেব বিনা বেতনে আজীবন শিক্ষকতা করেন। এই মাদ্রাসায় অনেক দেশবরেণ্য আলেম শিক্ষা লাভ করেছেন, যার মধ্যে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদার্রেসিনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা ওবায়দুল হক সাহেব (রহঃ) এবং চুনতীর শাহ সাহেব (শাহ হাফেজ আহমদ) (রহঃ)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


হযরত মাওলানা বশীর উল্লাহ সাহেব (রহঃ)

ছদাহার জানারপাড়ার প্রখ্যাত আলেম ছিলেন হযরত মাওলানা বশীর উল্লাহ সাহেব (রহঃ)। তিনি ভারতের শাহজাহানপুর মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ফারসি ভাষায় তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল, এবং তিনি অনর্গল ফারসি কবিতা আবৃত্তি করে ওয়াজ করতেন। রেঙ্গুনেও তাঁর ওয়াজ ব্যাপক সমাদৃত ছিল। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত 'বশিরীয়া তালিমুল মাদ্রাসা' এবং শাহ মজিদিয়া ফরিদিয়া রশিদিয়া হেফজখানা ও এতিমখানা আজও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাঁর সুযোগ্য পুত্র হযরত মাওলানা আহমদুর রহমান সাহেব (রহঃ) ছিলেন একজন সুদক্ষ মুহাদ্দিস ও বড় মাপের আলেম।

এছাড়াও ছদাহার আরও অনেক বিজ্ঞ আলেম ছিলেন, যেমন—মাওলানা আলী হোসেন সাহেব (রহঃ), যিনি আফজল নগরের এক উঁচু মানের আলেম ছিলেন। দেওয়ান আলী শাহ, একজন উঁচুমানের আধ্যাত্মিক সাধক ও আউলিয়া হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। মাওলানা আলীমুদ্দীন সাহেব (রহঃ), যিনি ফরায়েজ শাস্ত্রে খুবই দক্ষ ছিলেন। মাওলানা কাজী ইসহাক সাহেব, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন। ফজুরপাড়া নিবাসী হযরত মওলানা আবদুল জলিল (রহঃ), হযরত মাওলানা শফিকুর রহমান সাহেব (রহঃ), হযরত মাওলানা মুহাম্মদ তজম্মুল হোসাইন সাহেব (রহঃ) উকিয়ারকুল, এবং হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল সাহেব (রহঃ) প্রকাশ সুফী সাহেব প্রমুখ বিজ্ঞ আলেমগণ দ্বীনের খেদমতের পাশাপাশি শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। তাঁদের সকলের কীর্তি ছদাহার অতীত ইতিহাসকে আলোকিত করেছে এবং এই মহান ব্যক্তিত্বদের জীবন আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।