
আলহাজ্ব সৈয়দ মো. নুরুন্নবী
নারী শিক্ষার অগ্রদূত ও জনসেবার প্রতীক: আলহাজ্ব এস.এম. নুরুন্নবী
আলহাজ্ব সৈয়দ মোহাম্মদ নুরুন্নবী—একটি নাম, যা ছদাহার ইতিহাসে লেখা আছে শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক এবং জনগণের সেবক হিসেবে। তিনি কেবল একজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানই ছিলেন না, ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ, যিনি জীবনের প্রতিটি পদে প্রমাণ করে গেছেন দারিদ্র্য জয় করে কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়।
জন্ম ও শিক্ষা জীবনের লড়াই
১৯৫৯ সালের ১লা জানুয়ারি ছদাহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন কাজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ মোহাম্মদ নুরুন্নবী। শৈশবে দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ার এক অপ্রিয় অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও সংকল্পবদ্ধ করে তোলে। ১৯৭৪ সালে ছদাহা কেঁওচিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি পাশ করার পর তিনি শহরে পাড়ি জমান। ভর্তি হন মোহসেনিয়া মাদ্রাসার (বর্তমানে হাজী সরকারি মুহসিন কলেজ) বাণিজ্য বিভাগে। সেখানেও অর্থাভাবে পড়াশোনা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে পড়াশোনার পাশাপাশি টেরিবাজারে চাকরি নিয়ে তিনি ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর একই কলেজে ব্যাচেলর অব কমার্সে ভর্তি হলেও চাকরির কারণে পরীক্ষা দেওয়া আর সম্ভব হয়নি।
কর্মজীবন: সততা ও সাফল্যের গল্প
কর্মজীবনে তাঁর সততা আর কঠোর পরিশ্রম তাঁকে দ্রুত সাফল্যের শিখরে নিয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে তিনি জহুর হকার্স মার্কেটে নিজের দোকান কিনে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। আশির দশকে যখন বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পের কাজ শুরু হয়, তিনি সেই সুযোগকে কাজে লাগান। কাপড়ের ব্যবসার পাশাপাশি জাহাজের যন্ত্রাংশের ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। এই নতুন উদ্যোগই তাঁকে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলে, যার পর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জনগণের সেবায় এক জীবন
সৈয়দ মোহাম্মদ নুরুন্নবী জনগণের দুঃখ, দারিদ্র্য আর দুর্দশা অনুভব করতেন মন থেকে। নিজের অপ্রিয় অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন মানুষের সেবায়। ২০০৩ সালে তিনি ছদাহার পঞ্চম ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জনগণের সেবা করে গেছেন।
তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হলো:
-
ছদাহা আদর্শ মহিলা দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা (১৯৯৫): নারী শিক্ষার প্রসার এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুধু মাদ্রাসার জমি দানই করেননি, বরং তৎকালীন সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর সহযোগিতায় এটিকে এমপিওভুক্ত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে এই মাদ্রাসা থেকে বহু ছাত্রী উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশের বিভিন্ন নামীদামী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
-
চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণ: সাধারণ মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তিনি ১৯৯৯ সালে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে এ.কে. খান মোড়ে "আল আমিন হসপিটাল (প্রাইভেট) লিমিটেড" প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া প্রতিবছর তিনি ছদাহায় চক্ষু ও চিকিৎসা সহায়তা ক্যাম্প পরিচালনা করতেন, যা এলাকার মানুষের জন্য এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
-
ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের আধুনিক ভবন: বর্তমান ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের আধুনিক ভবনটি তাঁর ক্রয়কৃত জমির ওপর নির্মিত হয়েছে। তাঁর সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া সেই সময়ে এমন একটি ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হতো না।
দানশীল, পরোপকারী এবং মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা সম্পন্ন এই অসাধারণ মানুষটি ২০০৯ সালের ১১ই জানুয়ারি সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরলোকগমন করেন। তাঁর কীর্তি আজও ছদাহার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যা মানুষকে চিরদিন অনুপ্রাণিত করবে।