.png)
ছদাহার ম্যাপ
ছদাহা: এক সমৃদ্ধ জনপদের আখ্যান
বান্দরবানের সুউচ্চ পাহাড়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকা ছোট ছোট পাহাড়ের জনপদ। এর পূর্বাংশে যেদিকে তাকাই সেদিকেই চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সোনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ভৌগলিক অবস্থান দেখলে মনে হবে কোন নিখুঁত চিত্রশিল্পীর হাতে গড়া হয়েছে এই জনপদ। সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরপুর এই জনপদের উত্তরে কেঁওচিয়া, দক্ষিণে পদুয়া, পূর্বে বাজালিয়া ও বান্দরবান সদরের টংকাবতী ইউনিয়ন, পশ্চিমে সাতকানিয়া সদর ও চেমশা। বলছিলাম চট্টগ্রাম জেলা শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সুপরিচিত ও হালের বিখ্যাত জনপদ ছদাহার কথা।
সাতকানিয়া উপজেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন ছদাহা, ৭টি মৌজার ৬টি গ্রাম নিয়ে গঠন করা হয়েছে। এর ৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনে বর্তমানে ৮ হাজার পরিবারে ৫০ হাজার জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই ইউনিয়নের নামকরণে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে জনশ্রুতি আছে ইউনিয়নের নামের প্রস্তাব করেছেন ছদাহা গ্রামের মাওলানা শাকুরুল্লাহ। আলোকিত ছদাহা গঠনে ছদাহার অনেক গুণীজন নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। যাঁদের শ্রম, মেধা ও আত্মত্যাগে ছদাহা হয়েছে নানাভাবে সমৃদ্ধ। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সাবেক চেয়ারম্যান কেফায়েত উল্লাহ। যাকে আধুনিক হুদাহার রূপকার ও বলা হয়।
বর্তমানে ছদাহার সাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্য। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত ছদাহা মোহাম্মদীয়া খাইরিয়া আলিম মাদ্রাসা, আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত কে.ক উচ্চ বিদ্যালয়, আজিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ছদাহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া পার্শ্ববর্তী করইয়া নগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাঠ নিয়েছেন ছদাহার অসংখ্য শিক্ষাবিদ। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছদাহা মডেল হাইস্কুল ও একটি কলেজ। যা আগামীর ছদাহাকে আরও বেশি সমৃদ্ধ ও সম্ভবনাময় করে তুলবে। ছদাহার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ কমিশনার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার, আইনজীবী, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের এডমিন, ব্যাংকার, সরকারি কর্মকর্তা, প্রযুক্তিবিদ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা সহ সব নানান শ্রেণির মানুষ ও পেশাজীবী আছেন এই ছদাহায়।
ছদাহার ৩টি বাজারের মধ্যে রয়েছে ফকিরহাট, দস্তিদার হাট ও ছমদিয়া পুকুর পাড়। ফকিরহাটকে বলা হয় ছদাহার প্রাণকেন্দ্র। এই বাজার ও ইউনিয়ন পরিষদ কে ঘিরেই ছদাহার সব সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড আবর্তিত হয়। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম পাইকারি সবজির বাজার ও বসে আমাদের শিশুতলা বাজারে।
ছদাহায় নানা শ্রেণী পেশার মানুষ বসবাস করলেও, অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি। কৃষকদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। বিশেষ করে ছদাহার বেগুন না হলে তো ভোজনরসিকের ভোজন ঠিক জমেই না। ছদাহার বারোমাসি তরমুজ, বেগুন ও মরুর ফল শাম্মাম পৌঁছেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত। ছদাহার সবচেয়ে বিকাশমান সম্ভাবনাময় একটি খাত হলো মৎস্য খাত। বর্তমানে পূর্ব ছদাহার অধিকাংশ পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মৎস চাষ করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন তরুণ উদ্যোক্তা। প্রতিবছর এই মৎস খাত থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার উপরে আয়
হয়।
ছদাহার সবুজ প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে যে কোন প্রকৃতি প্রেমীদের। প্রকৃতি প্রেমীরা মন ভরে উপভোগ করে এর সৌন্দর্য, মেটায় অন্তরের বৃষ্ণা। ছদাহার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে মুফতি বাড়ি ও ছগির শাহ পাড়া। এছাড়া পূর্ব ছদাহার শৈলকূপ, নীলাচল, নীলগিরির মতো সুউচ্চ পাহাড়ের বুকে হেলান দিয়ে বসে থাকা ছোট ছোট পাহাড়, হাঙ্গর বিধৌত উর্বর পলিমাটি, রয়েছে খাল বিল, অসংখ্য ঝিরি- শৈলকুপার মতো সৃষ্টিনন্দন ঝরণা, এছাড়া রয়েছে অসংখ্য প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পাহাড়ি লেকের অপূর্ব সমন্বয়। ছদাহার হাঙ্গর খালের দুই তীরে চোখে পড়ে শুভ্র কাশফুলের অপূর্ব সমারোহ। এখানে বিলে ঝিলে ফোঁটে নাম না জানা বাহারি ফুল ও শালা। এখানে, ছোটবড়ো ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা পাচারীতে অসংখ্য নৌকা চোখে পড়ে।
ছদাহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভৌগলিক অবস্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়,
"আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন, এই মাটিতে রখো। অমূল্য রতন"
যাহার বুক চিরে চলে গেছে আরাকান সড়ক। যার বিস্তৃতি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার পর্যন্ত। অপরদিকে সীমানা ঘেঁষে গেছে বান্দরবান দিক। আরাকান সড়ক দিয়ে কাকডাকা ভোর থেকে হর্ণ বাজিয়ে দিব্যি ছুটে চলে নেলের বিতরন্ন প্রান্ত থেকে আসা বাহারি যাত্রীবাহী গাড়ি। এখানে ওমানে দক্ষ ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠেছে টাইম ক্যাফে, ফিডব্যাক ও লাইমওড এর মতো আধনিক রেস্তোরাঁ। যেখানে শত শত ভ্রমণপিপাসু যাত্রাবিরতি এরেন। এর ফলে মানুষজন এই অঞ্চল সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে উঠছে।
জনাহায় রয়েছে এগ্রো ও ভিলেজ ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদে ভরপুর এই জনপদটিকে যদি একটি পরিকল্পিত রূপ দেওয়া নায়, তাহলে ছদাহা সমগ্র দেশের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। এখানে শিক্ষিত তরুণ ও যুবসমাজকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে ছদাহাকে শিক্ষা ও সার্বিকভাবে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা সম্ভব। এর ফলে একদিকে যেমন স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থান হবে, তেমনি অন্যদিকে তারা তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে ছদাহার উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে। এগ্রো ও ভিলেজ ট্যুরিজম ছদাহার অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। পর্যটকদের আগমন বাড়লে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হবে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। একই সাথে আমাদের ছদাহার স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেশব্যাপী এবং সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে।